খামার ব্যবস্থাপনা

মৎস্য খামার ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানে দারিদ্র বিমোচন

ভূমিকাঃ
বাংলাদেশসহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে খাদ্য ও পুষ্টির নিরাপত্তা বিধান, আয় বৃদ্ধি, কর্মস্থানের সুযোগ সৃষ্টি এবং সর্বোপরি দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে মৎস্যচাষ একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পন্থা হিসেবে বিবেচিত। চাষের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬ষ্ঠ (তথ্যসূত্র-১)। দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনের ৩৯% এবং অভ্যন্তরীণ মৎস্য উৎপাদনের ৪৯% মৎস্যচাষের অবদান (তথ্যসূত্র-২)। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ১০% প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৎস্য উৎপাদন, আহরণ ও সংশ্লিষ্ট কাজের সাথে জড়িত। গ্রহণকৃত প্রাণিজ আমিষের প্রায় ৬০ শতাংশই আসে মাছ থেকে। দেশের মোট আয়কৃত বৈদেশিক মুদ্রার ৪.৯% আসে রপ্তানীকৃত মৎস্য পণ্য হতে যার সিংহভাগই মৎস্যচাষের অবদান (তথ্যসূত্র-৩)। বিগত দুই দশকে আহরণকৃত মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি হয়েছে ৬% যেখানে চাষকৃত মৎস্য উৎপাদনের বৃদ্ধি হয়েছে ২২% এবং এটা প্রমাণ করে যে, আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশের জনগণের মৎস্যচাষের উপরে নির্ভশীলতা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সর্বোপরি, মৎস্যচাষে সংশ্লিষ্ট গবেষণা, প্রযুক্তি ও প্রযুক্তি বিস্তারের উন্নয়নে নিয়োজিত তুলনামুলক কম জনশক্তি সম্পন্ন ফিশারীজ সাবসেক্টর আজকে জাতীয় উন্নয়নে সর্বাধিক ভূমিকা নিশ্চিত করেছে। কিন্তু ক্রমবর্ধনশীল জনগোষ্ঠীর প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ, বিশেষ করে দরিদ্র, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান, জাতীয় ও আঞ্চলিক পর্যায়ে দারিদ্রের প্রবণতা, খাদ্য উৎপাদনের জন্য পারিবেশিকভাবে সঙ্কটাপন্ন অঞ্চল এবং জলাবায়ু পরিবর্তন জনিত প্রভাব- এই সমস্ত দিকসমূহের বিবেচনায় মৎস্যচাষের বর্তমান ও ভবিষ্যত উন্নয়ন আজকে হুমকির মুখে। বিশেষ করে পারিবেশিকভাবে সঙ্কটাপন্ন বরেন্দ্র ভূমি এবং মঙ্গা অধ্যুষিত উত্তর অঞ্চলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং দারিদ্র বিমোচনে সহায়ক মৎস্য চাষের উন্নয়নে বর্তমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনাসমূহের অনুধাবন, বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতাসমূহ চিহ্নিতকরণ এবং সম্ভাব্য সকল সম্ভবনাপূর্ণ দিকসমূহের উন্মোচন অতীব গুরুত্বপূর্ণ।
মাছের খামার থেকে মাছ আহোরণ

বর্তমান চ্যালেঞ্জসমূহঃ
** চাহিদা অনুযায়ী মৎস্য উৎপাদনের ঘাটতি রয়েছে।
জনপ্রতি মাছের বাৎসরিক চাহিদা ১৮ কেজি এবং জনপ্রতি বাৎসরিক মাছ গ্রহণ ১৬.৬২ কেজি অর্থাৎ চাহিদা অনুযায়ী বাৎসরিক মাছ গ্রহণের ঘাটতি রয়েছে জনপ্রতি ১.৩৮ কেজি (তথ্যসূত্র-৩)।
** কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে সহায়ক রপ্তানীমুখী মৎস্যচাষ শিল্পের প্রসার আশানুরূপ হচ্ছে না।
রপ্তানীর জন্য কাঁচামাল (মূলতঃ চিংড়ী) সরবরাহের অভাবে দেশের প্রক্রিয়াজাত কারখানাসমূহের উৎপাদন মাত্রর মাত্র ২০ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে (তথ্যসূত্র-৪)।
** পুষ্টির উন্নয়ন কাংঙ্খিত নয়। প্রতিদিন ১৮০৫ কিলোক্যালোরীর-ও কম খাদ্য গ্রহণ করে ২৬ শতাংশ জনগোষ্ঠী; সঠিক বৃদ্ধি না হওয়া জনগোষ্ঠী ৪৩.২ শতাংশ; স্বাভাবিকের চেয়ে কম ওজনের শিশুর সংখ্যা ৪১ শতাংশ (তথ্যসূত্র-৫)।
** প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশই দারিদ্র সীমার নীচে এবং চরম দারিদ্র অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহের মধ্যে উত্তর অঞ্চল অন্যতম।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দরিদ্রতার নির্দেশকসমূহ হচ্ছে- জমির পরিমাণ সীমিত (০.২-০.৫ হেক্টর), পুকুর থাকলেও তার আকার ছোট অথবা বহুমালিকানাযুক্ত পুকুরের অংশীদার, প্রত্যেক বছর কয়েক মাসের জন্য খাদ্য ঘাটতিতে ভোগে, সাময়িক দিন মজুর হিসেবে কাজ করে, বসতবাড়ী থাকলেও তাদের পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা খুবই নিম্নমানের এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তারা তাদের জীবনমানের উন্নয়নের জন্য অবস্থাপন্ন ব্যক্তি বা বেসরকারী সংস্থার নিকট সহযোগিতা চায় (তথ্যসূত্র-৬)। ২০০৫ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ৩৪.৩ শতাংশই দারিদ্র সীমার নীচে অবস্থান করে এবং মৌলিক চাহিদার ব্যায় অনুসারে রাজশাহী বিভাগে তথা উত্তর অঞ্চলের দারিদ্রের হার ৫১.২ শতাংশ (তথ্যসূত্র-৭)।
** মৎস্যচাষ প্রযুক্তি এবং জলবায়ু পরিবর্তন পুষ্টি গ্রহণের ভিত্তিতে আঞ্চলিক দারিদ্রতাকে প্রভাবিত করছেঃ
এদেশে পদ্ধতিগত মাছ চাষের ধারণা শুরু হয় ৮০র দশকে। মূলতঃ মৎস্য গবেষণা ইনষ্টিটিউট প্রতিষ্ঠার পর হতেই মাছ চাষে লাগসই প্রযুক্তির উদ্ভাবণ প্রক্রিয়া ও মাঠ পর্যায়ে এর প্রয়োগ বাস্তব রুপ লাভ করে। উল্লেখ্য যে, ইনষ্টিটিউট কর্তৃক উদ্ভাবিত প্রযুক্তি সমূহ মৎস্য অধিদপ্তরসহ অন্যান্য সরকারি বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দেশব্যাপী হস্তান্তরিত হয়েছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশ সফলতা যেমন পাওয়া গেছে তেমন কিছু সমস্যাও চি‎হ্নিত হয়েছে। একই প্রযুক্তি দেশের সমগ্র কৃষি পারিবেশিক অঞ্চলের জন্য গ্রহণযোগ্যতা পায়নি এবং একই প্রযুক্তি হস্তান্তরে বিভিন্ন সংস্থার তথ্যেও ব্যাপক ভিন্নতা দেখা যায়।
প্রযুক্তিসমূহের সম্প্রসারণ যেমন কিছু কিছু অঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থেকেছে তেমনি কিছু কিছু গোষ্ঠীও সম্প্রসারণ সেবা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর অথবা অবহেলিত জনগোষ্ঠীর মধ্যে আদিবাসী অন্যতম। বাংলাদেশে কমকপক্ষে ৪৫টি জাতির প্রায় ২৫-৩০ লক্ষ আদিবাসীর বসবাস যা এদেশের মোট জনসংখ্যার তুলনায় নগন্য হলেও পৃথিবীর অনেক দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশী। সঠিক পরিকল্পনা এবং উন্নয়ন কৌশলের অভাবে এদের জীবন আজ বিপন্ন । মাছচাষের উপযোগী গৃহস্থালী পুকুর, উপযুক্ত কৌশল নির্ধারণপূর্বক বহুমালিকানা/বর্গাপ্রথার অন্তর্ভুক্ত ধানের জমি এবং পুকুরসমূহে মাছ চাষের মাধ্যমে আদিবাসীদের জীবনমান উন্নয়নের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে ।
দেশের যে অঞ্চলে মৎস্য চাষ প্রযুক্তির উন্নয়ন ও বিস্তার ভাল হয়েছে সে অঞ্চলে জনপ্রতি মৎস্য গ্রহণের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। একইভাবে, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত দূর্যোগের কারণে জনপ্রতি মৎস্য গ্রহণের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে (সারণী-১)।

মাছ আহোরণ

মঙ্গাপ্রবন উত্তর অঞ্চলে বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে চরম খাদ্যাভাব এবং কাজের অভাব একটি নিয়মিত ঘটনা। বন্যার প্রবণতা এবং নদীভাঙ্গন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমানকে প্রতিনিয়ত সংকটাপন্ন করে তুলছে। অন্যদিকে, উত্তর অঞ্চলের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ বরেন্দ্রভূমির অন্তর্গত যেখানকার মাটি (কম জৈব পদার্থ সম্পন্ন) ও পানির গুনাগুণ (উচ্চ ঘোলাত্ব এবং কম ক্ষারকত্ব সম্পন্ন) মৎস্য উৎপাদনের জন্যই একটি বিশাল অন্তরায় (তথ্যসূত্র-১২)। আঞ্চলিকভাবে খুবই সীমিত আকারে গবেষণার মাধ্যমে কিছু প্রযুক্তির উন্নয়ন হলেও সেখানে জাতীয় গবেষণা ও সম্প্রসারণ প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ের অভাবে সংকটাপন্ন উত্তর অঞ্চলে মৎস্য উৎপাদনের পরিমাণ যেমন কম (তথ্যসূত্র-২) তেমনি দারিদ্রতার মাত্রাও বেশী (তথ্যসূত্র-১৫)।
সারণী-১: অঞ্চলভিত্তিক মৎস্যভক্ষণ।

অঞ্চল                      বছর              ঋতু       মৎস্যভক্ষণ (গ্রাম/জন/দিন)       মন্তব্য            তথ্যসূত্র
*গ্রামীণ বাংলাদেশ      ১৯৮১-৮২      -                ২৩                                    -                 ১৩
*টাঙ্গাইল                  ১৯৯২              -                ১২                          খরা প্রবণ বছর        ১৩
*সিংড়া                    ১৯৯২              -                ২২                                     -                 ১৩
*ময়মনসিংহ             ১৯৯৭     জুন-সেপ্টেম্বর                                  নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠী    ১৩
                                                                                                কর্তৃক ভক্ষণ অপেক্ষা- 
                                                                                                কৃত কম হয়েছে।
-নিম্ন আয়                                                       ৩০
-মধ্যম আয়                                                     ৪১
-উচ্চ আয়                                                       ৪১  
        
*কাপাশিয়া             ১৯৯৮-৯৯  আগস্ট-জুলাই                             ইকলার্ম ও এম.এ.ই.পি.     ১৩
                                                                                              প্রকল্পের প্রভাব                                       
-ক্ষুদ্র খামার                                                   ৮৩
-মধ্যম খামার                                                ৮৫
-বৃহৎ খামার                                                  ৯৬              
  
*দিনাজপুর            ১৯৯৯   অক্টোবর-ডিসেম্বর   ৩৪            সি.বি.এফ.এম. প্রকল্পের প্রভাব     ১৩
  (আশুরার বিল)              
*গোদাগাড়ী,          ২০০৮              -                ২৮                খরা প্রবণ বরেন্দ্র এলাকা        ১৪
  রাজশাহী   

চ্যালেঞ্জ মেকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনাসমূহঃ
** কর্মসংস্থান ও দারিদ্র বিমোচনে প্রাতিষ্ঠানিক বিশেষ কৌশল/নীতি/সুপারিশসমূহের সঠিক বাস্তবায়নঃ
দেশে বিদ্যমান বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নীতি/কৌশল বা সুপারিশসমূহ মাছ চাষের মাধ্যমে উত্তর অঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান ও দারিদ্র বিমোচনে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে (সারণী-২)।

সারণী-২: দারিদ্র নিরসনে সহায়ক প্রাতিষ্ঠানিক কৌশল/নীতি/সুপারিশসমূহ।

প্রাতিষ্ঠানিক কৌশল/নীতি/সুপারিশসমূহ                                                                                  তথ্যসূত্র
২য় দারিদ্র নিরসন কৌশলপত্রঃ আঞ্চলিক দারিদ্র বৈষম্য নিরসন                                                         ৭
*রোড ম্যাপ ষ্ট্র্যাটেজি (ফিশারীজ সাবসেক্টর): প্লাবনভূমি ও মুক্ত জলাশয়ে সমাজভিত্তিক মৎস্য চাষ        ৩
*ফিশারীজ সেক্টর রিভিউ ভিত্তিক সুপারিশঃ অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে মাছচাষে অংশগ্রহণ                   ১৬
*কৃষি মন্ত্রণালয়ঃ কৃষি (শস্য ও মৎস্য উভয়ই): গবেষণা ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণ                                    ৭
*যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ঃ বেকার যুবকদের দীর্ঘমেয়াদী মৎস্যচাষ প্রশিক্ষণ ও ঋণ প্রদান।                      ৭
*পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ঃ কৃষি ও মৎস্যক্ষেত্রে পানি ব্যবহারকারীদের চাহিদা মোতাবেক                         ৭
  ভূ-উপরিস্থিত পানি ব্যবহারের একটি সার্বিক ও সমন্বিত উদ্দ্যোগ গ্রহণ।  
     
** জলবায়ু পরিবর্তন এবং পারিবেশিকভাবে সংকটাপন্ন এলাকার (খরা প্রবণ বরেন্দ্র ভূমি এবং বন্যা প্রবণ মঙ্গা এলাকা) জন্য উপযোগী মৎস্যচাষ প্রযুক্তির উন্নয়নঃ
মঙ্গা এবং বরেন্দ্র উভয় অঞ্চলে শুধুমাত্র পুকুরের উপর নির্ভর না করে অন্যান্য জলাশয়ের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের মাছ চাষের সুযোগ প্রদানের জন্য প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটাতে হবে। বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচ নির্ভর প্রান্তিক কৃষকদের ক্ষেত্রে সেচের উন্নয়নে শস্যের নিবিড়তা বাড়লেও তাদের উৎপাদন খরচ বেড়েছে, প্রাণিজ আমিষ গ্রহণের পরিমাণ কমেছে এবং সর্বোপরি দারিদ্রতার মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে (তথ্যসূত্র-১৪)। মঙ্গা ও বরেন্দ্র উভয় অঞ্চলের জন্য যে সমস্ত প্রযুক্তিসমূহের উন্নয়ন ও বিস্তার ঘটানো প্রয়োজন তা হলো- মৌসুমী জলাশয়ে দ্রুত বর্ধনশীল মাছ চাষ, বিশেষতঃ বরেন্দ্র অঞ্চলে; খাঁচায় মাছ চাষ (পুকুর, বিল/প্লাবনভূমি ও নদী), বরেন্দ্র ও মঙ্গা উভয় অঞ্চলে; বিল এবং প্লাবনভূমিতে মাছচাষ; পুকুরে ও ধানক্ষেতে মাছ ও চিংড়ীর চাষ; বিশেষতঃ বরেন্দ্র অঞ্চলের সেচ নির্ভর কৃষকদের আয় বৃদ্ধিতে ধানক্ষেতে মাছ/চিংড়ীর চাষ; খাঁড়ি ও খালে পেন বা খাঁচায় মাছ চাষ; মরা নদীতে (কোল বা কোলায়) মাছ চাষ, বিশেষতঃ মঙ্গা অঞ্চলে এবং মাটি ও পানির গুনাগুনের উন্নয়নের মাধ্যমে মাছ চাষের উন্নয়ন, বিশেষতঃ বরেন্দ্র অঞ্চলে।
** প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য উপযোগী মৎস্যচাষ সম্প্রসারণ কৌশলের উন্নয়ন ও বিস্তারঃ
এক্ষেত্রে কৃষক মাঠ স্কুল এবং সমাজভিত্তিক মাছ চাষ-এর মত কৌশলসমূহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

 মাছ চাষের জন্য উত্তর অঞ্চলের সম্ভাবনাময় জলাশয়সমূহের ব্যবহারঃ
প্রান্তিক জনগোষ্ঠী যাদের নিজস্ব পুকুর নেই, খাস পুকুর ও খাঁড়ি, বিল, প্লাবনভূমি এবং নদীতে মাছচাষের সুযোগ দিয়ে তাঁদের কর্মস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র বিমোচনে সহায়তা করা সম্ভব। উত্তর অঞ্চলে এই ধরনের সম্ভবনাময় জলাশয়ও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে আছে (সারণী-৩)।

সারণী-৩: মাছচাষের জন্য উত্তর অঞ্চলের (রাজশাহী বিভাগের) সম্ভাবনাময় জলাশয়সমূহ।

জলাশয়                 সংখ্যা       আয়তন                       তথ্যসূত্র
গুরুত্বপূর্ণ খাঁড়ি       -             ৯৬৫.০৫ কি.মি.             ১৭
পুকুর                     -             ৭৪৯৫৪ হেক্টর                  ২
খাঁস পুকুর            ৬৩২৩      ৩৩৫৫ হেক্টর                ১৪
                                          (গোদাগাড়ী, তানোর, 
                                           নিয়ামতপুর, নাচোল
                                           উপজেলা)     
নদী ও খাল              ২৯০       ১১৭০০০ হেক্টর          ১৮
বিল                          -          ৩৩৬৪৯ হেক্টর             ২
প্লাবনভূমি                  -          ৬০৯৯৮২ হেক্টর       ১৮

চাষের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধিতে সাম্প্রতিক প্রচেষ্টাসমূহঃ
মৎস্য চাষের জন্য উত্তর অঞ্চলে বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের উদ্দ্যোগে সাম্প্রাতিক যে সকল প্রচেষ্টাসমূহ গ্রহণ করা হয়েছে তা হলোঃ বিল, প্লাবনভূমি এবং মরা নদীতে মাছচাষ, খাঁচায় মাছ চাষ, পুকুরে মাছ এবং চিংড়ীর চাষ, ধান ক্ষেতে মাছচাষ, মৌসুমী পুকুরে মাছচাষ এবং দরিদ্র আদিবাসী জনগোষ্ঠী কর্তৃক পুকুরে এবং ধানক্ষেতে মাছ চাষ।
উপরোক্ত প্রচেষ্টাসমূহের মাধ্যমে দরিদ্র/প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে মাছ চাষে অংশগ্রহণের সুযোগ দিয়ে তাঁদের কর্মসংস্থান ও আয় বৃদ্ধিতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বেশ সফলতা পাওয়া গেছে এবং একইসাথে মাছ চাষের জন্য কিছু সমস্যাও চিহ্নিত হয়েছে। প্রভাবশালী মহল কর্তৃক খাস জলাশয়সমূহের নিয়ন্ত্রণ, ভূ-গর্ভস্থ পানির অতিমাত্রায় ব্যবহারে বেশ কিছু জলাশয়ে পানির অভাবে মাছ চাষের অনুপযোগিতা, বর্গা চাষের ক্ষেত্রে মালিক-চাষীর মধ্যে বিদ্যমান চুক্তি বা শর্তের দুর্বলতা, সঠিক সময়ে কাংঙ্খিত ও মানসম্পন্ন পোনা প্রাপ্তির অভাব এবং স্বল্পমূল্যের মৎস্য খাদ্যের অভাব।

ভবিষ্যৎ উন্নয়নের প্রতিবন্ধকতাসমূহঃ
উত্তরাঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী কর্তৃক ভবিষ্যত মৎস্য চাষের উন্নয়নের জন্য নিম্নোক্ত বিষয়গুলো প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছেঃ উত্তরাঞ্চলের বহু জলাশয় (বিশেষ করে খাস পুকুর, খাঁড়ি, বিল/প্লাবনভূমি ইত্যাদি) প্রভাবশালীদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠী মাছ চাষের সুযোগ পাচ্ছে না; অতিমাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের কারণে খাঁড়িসমূহ সেচ ও মৎস্য চাষের জন্য অনুপযোগী হয়ে পড়ছে; মালিক-চাষীর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদী ও আনুষ্ঠানিক চুক্তির অভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে বহুমালিকানা/বর্গা প্রথার আওতায় পুকুর বা ধানক্ষেতে মাছ চাষের জন্য সঠিকভাবে সুযোগ সৃষ্টি করা যাচ্ছে না; সঠিক সময়ে মানসম্পন্ন পোনা ও স্বল্পমূল্যের খাদ্যের অভাব মাছ চাষ বাধাগ্রস্থ করছে এবং মাটি-পানির গুনাগুণ, জলবায়ু পরিবর্তন এবং কৃষি পারিবেশিক অঞ্চলের ভিন্নতায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উপযোগী মৎস্য চাষ প্রযুক্তি ও তাঁর বিস্তারের উন্নয়নে পর্যাপ্ত গবেষণার অভাব রয়েছে।

প্রতিবন্ধকতা উত্তরণের সুপারিশসমূহঃ
• প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের খাস জলাশয়ের সংস্কার ও মাছ চাষের সুযোগ প্রদানের জন্য বিদ্যমান সরকারী-বেসরকারী সমন্বিত উদ্দ্যোগকে তরান্বিত করা প্রয়োজন।
• হুমালিকানা/বর্গা/ইজারা প্রথার আওতায় বিভিন্ন জলাশয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের টেকসই মাছ চাষের জন্য মালিক-চাষীর দীর্ঘমেয়াদী আনুষ্ঠানিক চুক্তির প্রয়োজন।
• সময়মত মানসম্পন্ন পোনা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধানে উত্তরাঞ্চলে পর্যাপ্ত ব্রুড ব্যাংক স্থাপনের জন্য সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন।
• জলবায়ু পরিবর্তন (বন্যা ও খরা মোকাবেলা) -কে বিশেষ প্রাধান্য দিয়ে উত্তরাঞ্চলের বি.এফ.আর.আই.-এর গবেষণা কলেবর (গবেষণাগার ও লোকবল) বৃদ্ধি করা অতীব প্রয়োজন।
• বিশ্ববিদ্যালয়, বি.এফ.আর.আই. ও অন্যান্য সংস্থার কোলাবরেটিভ গবেষণা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
• মৎস্য অধিদপ্তরের উত্তর অঞ্চলকে প্রাধান্য দিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীদের মাছ চাষ সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ ও সংরক্ষণ পদ্ধতির উন্নয়নে বিশেষ প্রকল্প গ্রহণের প্রয়োজন।
 
উপসংহারঃ
উত্তর অঞ্চলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও দারিদ্র বিমোচনে মৎস্যচাষই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে যদি বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতাসমূহ উত্তরণে পর্যাপ্ত গবেষণা, প্রযুক্তির উন্নয়ন ও তার বিস্তারে জরুরী পদপে নেওয়া যায়।
Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...